উখিয়া নিউজ ডটকম
প্রকাশিত: ০৭/১১/২০২৫ ২:৪৪ পিএম
ফাইল ছবি

এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার 
দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক ও পর্যটনকেন্দ্রিক সড়ক চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক এখন মানুষের মনে এক ভয়াল নাম—‘মৃত্যুর সড়ক’। অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, সংকীর্ণ লেন, বাঁকানো রাস্তা ও শৃঙ্খলার অভাব মিলিয়ে সড়কটি হয়ে উঠেছে দুর্ঘটনার স্থায়ী ঠিকানা। প্রতিনিয়ত প্রাণহানি ঘটলেও চার বা ছয় লেনে সম্প্রসারণের সরকারি পরিকল্পনা বছরের পর বছর ফাইলবন্দী। চলতি বছরের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজার চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে গুরুতর আহত হয়েছে ১৩২ জন।

দুর্ঘটনা থেমে নেই, বরং বাড়ছে

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে এই মহাসড়কে দুই শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। লোহাগাড়া, চকরিয়া, সাতকানিয়া ও পটিয়া এলাকায় দুর্ঘটনার হার সবচেয়ে বেশি। সড়কের অন্তত ২১টি পয়েন্টকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)।

লবণবোঝাই ট্রাক, পর্যটকবাহী বাস, পণ্যবাহী কাভার্ড ভ্যান- সব ধরনের যানবাহন এই দুই লেনের সড়কে একসঙ্গে ছুটছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্রুতগামী যানবাহনের ওভারটেকিং, পিচ্ছিল রাস্তা, রাতে আলোর স্বল্পতা এবং অদক্ষ চালনা দুর্ঘটনার বড় কারণ।

১০ মাসে ৮৪ জনের মৃত্যু

বিআরটিএ কক্সবাজার কার্যালয়ের এক পরিসংখ্যান বলছে, চলতি মাসের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজার চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৮২ টি সড়ক দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। এই ঘটনায় নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন ১৩২ জন।

সূত্রটি বলছে, গেল বুধবার ৫ নভেম্বর কক্সবাজার চট্টগ্রাম মহাসড়কে সংগঠিত দুর্ঘটনায় কবলিত মারসা গাড়িটির রোড পারমিট মেয়াদ শেষ হয়েছে আরও দুই মাস আগে।

জনঅসন্তোষে দাবির ঝড়

মহাসড়ক প্রশস্ত করার দাবিতে কয়েক বছর ধরেই চলছে আন্দোলন। লোহাগাড়া, কক্সবাজার, চকরিয়া, রামু, ঈদগাঁও ও পটিয়া এলাকায় বহুবার মানববন্ধন, সড়ক অবরোধ ও গণসমাবেশ হয়েছে। স্থানীয়দের একটাই দাবি- ‘আর দেরি নয়, এখনই ছয় লেন’। বুধবার চকরিয়ায় একই পরিবারের পাঁচ সদস্য নিহত হওয়ার পর চট্টগ্রাম নগরের চেরাগি পাহাড় মোড়ে আবারও মানববন্ধন হয়েছে।

বক্তারা বলেন, এই সড়ক এখন ‘মৃত্যুফাঁদ’, যার ভয়াবহতা উপেক্ষা করা মানে আরও লাশ বাড়ানো।

বেলা’র লিগ্যাল নোটিশে নতুন বিতর্ক

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পে সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছে সরকারের ১৩টি দপ্তরে। তাদের দাবি, লোহাগাড়ার চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যসহ কয়েকটি এলাকায় পরিবেশ ও প্রাণীর আবাসস্থল নষ্ট হবে। তাই ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে ইমপ্রুভমেন্ট (ফেজ-২)’ প্রকল্পের কার্যক্রম স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, মানবজীবন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে সমাধান সম্ভব হলেও প্রকল্প পুরোপুরি আটকে দেওয়া সমাধান নয়।

কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, “এটা শুধু সড়ক নয়— দক্ষিণাঞ্চলের জীবনরেখা। পরিকল্পনার ফাইল টেবিলে পড়ে থাকলে মৃত্যুর মিছিলই শুধু দীর্ঘ হবে।”

প্রকল্প আছে, কিন্তু মাঠে নেই

সওজ সূত্রে জানা গেছে, ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট-১’ একনেকে পাস হয়েছে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে। প্রথম পর্যায়ে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে চার লেনের বাইপাস ও একটি ছয় লেনের ফ্লাইওভার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শ্যামল কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, “প্রায় ২৩ দশমিক ৫২ কিলোমিটার অংশে বাইপাস ও ফ্লাইওভার নির্মাণে জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এখন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে পরামর্শক নিয়োগের টেন্ডার আহ্বান করা হবে। আশা করছি এক বছরের মধ্যে কাজ শুরু করা যাবে।”

প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে ৫ হাজার কোটি দেবে জাপানি সংস্থা জাইকা। দ্বিতীয় পর্যায়ে দেড়শ কিলোমিটার চার লেন সড়ক নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। তবে সংরক্ষিত বন ও বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের কারণে বিকল্প নকশা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

বন বিভাগ জানিয়েছে, নতুন করে কোনো বনাঞ্চলের জমি বরাদ্দ দেওয়া হবে না।

বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা

পরিবহন ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, প্রশাসনিক বিলম্বই সড়কটির প্রধান বাধা। তাদের মতে, প্রতিবছর যখন শতাধিক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন, তখন নথিপত্রে প্রকল্প আটকে থাকা মেনে নেওয়া যায় না।

তারা সুপারিশ করেছেন- প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট সময়সীমা ঘোষণা, অগ্রগতি প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশ, ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে অস্থায়ী বিকল্প ব্যবস্থা ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান।

প্রাণের মূল্যেই উন্নয়নের মাপকাঠি

মহাসড়ক প্রশস্ত করার দাবিতে ইতোমধ্যে ঢাকায়ও মানববন্ধন হয়েছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত এক কর্মসূচিতে বক্তারা বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় পর্যটন শহরের প্রবেশপথ যখন প্রাণঘাতী সড়কে পরিণত হয়, তখন উন্নয়নের গল্প অসম্পূর্ণ থাকে।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, “কক্সবাজারের পর্যটন, দক্ষিণ চট্টগ্রামের অর্থনীতি ও রোহিঙ্গা শিবিরের ত্রাণ কার্যক্রম-সবকিছুই এই সড়ক নির্ভর। তাই এটি ছয় লেনে উন্নীত করা সময়ের দাবি নয়, জীবনরক্ষার দাবি।”

দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারবাসীর দাবি, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক শুধু দুই জেলার সংযোগ নয়, এটি দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের উন্নয়ন, বাণিজ্য ও পর্যটনের প্রধান ধমনি। কিন্তু আজ এই সড়কই জনজীবনের আতঙ্ক। সরকার ও উন্নয়ন অংশীদারদের সিদ্ধান্ত যত দেরি হবে, তত বাড়বে মৃত্যুর মিছিল। তাদের প্রশ্ন এখন একটাই- পরিকল্পনার ফাইল আগে নড়বে, নাকি আবারও লাশ উঠবে এই সড়ক থেকে।

ছয় লেনে বড় বাধা বনবিভাগ

এ বিষয়ে বন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সড়ক সম্প্রসারণের জন্য বনের জমি চাওয়া হলে তা দিতে অস্বীকৃতি জানায় বন বিভাগ। এক্ষেত্রে একাধিক বিকল্প প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকায়নে বিকল্প সড়কপথ তৈরি ছাড়াও ২৭ কিলোমিটার বনের অংশে প্রতি ৩ কিংবা ৫ কিলোমিটার অন্তর আন্ডারপাস ও উড়াল সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে সম্প্রসারণ কাজ বাস্তবায়ন।

বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চুনতি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে বনটির আয়তন প্রায় ৭ হাজার ৭৬৪ হেক্টর। এর সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও বিপন্ন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ১৯৮৬ সালে এ অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে এশীয় বন্য হাতির যাতায়াতের একটি সংযোগ পথ বা করিডোর হিসেবেও এ অভয়ারণ্য গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া কক্সবাজারের মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান ও প্রাকৃতিক বনের আয়তন প্রায় ৩৯৬ হেক্টর। অন্যদিকে কক্সবাজারের ১ হাজার ৩০৩ হেক্টর জমি নিয়ে ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের একটি অংশও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মধ্যে পড়েছে। বর্তমানে মহাসড়কটির সরু একটি অংশ বনের ভেতর দিয়ে গেছে। এটি সম্প্রসারণ করলে বনের বিপুল পরিমাণ জমি সড়কে চলে যাবে। এতে বন ও বন্যপ্রাণীর বসবাস, চলাচলসহ জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হওয়ার শঙ্কায় ভারী অবকাঠামো কিংবা সড়ক সম্প্রসারণে জমি দিতে চাইছে না বন বিভাগ।

বন অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিম বলেন, ‘সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য আর কোনো বনের জমি বরাদ্দ দেবে না বন বিভাগ। আগের রাজনৈতিক সরকারের আমলে রেলপথ নির্মাণের ফলে চুনতিসহ তিনটি বৃহৎ বনের বড় ধরনের ক্ষতি করা হয়েছে। সড়কপথ সম্প্রসারণেও বিপুল পরিমাণ জমির প্রয়োজন হবে। তাই সম্ভাব্যতা যাচাইকালে জানতে চাওয়া হলে আমরা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার যোগাযোগে বিকল্প সড়কপথ তৈরির প্রস্তাব করেছি। তাছাড়া মাটির তলদেশ কিংবা উড়ালপথে সড়ক সম্প্রসারণেরও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সড়ক নির্মাণে কোনো অবস্থায়ই বনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে দেয়া হবে না।’

যা বললেন কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগ

সড়কটি চার লেনে উন্নীত করা সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে জানিয়ে কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রোকন উদ্দিন খালেদ চৌধুরী বলেন, ‘জাইকার সহযোগিতায় সড়কটি বাস্তবায়নের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ পর্যায়ে এসেছে।’

স্থানীয়দের ছয়লেনে দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে বলা যাবে এটি চার লেনে হবে নাকি ছয় লেনে হবে।

পাঠকের মতামত